জিঙ্ক মানবদেহের একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তাসহ নানাবিধ শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ার জন্য অতিপ্রয়োজনীয়। মানবদেহের ২০০-এর অধিক এনজাইমের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য জিঙ্ক একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। এর অভাবে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি যেমন-ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। পরিণামে শিশুদের অকাল মৃত্যুসহ বুদ্ধিমত্তা হ্রাসের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি বিনির্মাণে বিরাট অন্তরায়।
আমাদের দেশের শতকরা ৪০ ভাগের বেশি মানুষ বিশেষ করে শিশু ও নারীদের জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। আর্থসামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের দেশের বহু দরিদ্র মানুষ দৈনন্দিন পুষ্টির জন্য একমাত্র ভাতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ভাতে অন্যান্য খনিজ উপাদানের মতো জিঙ্কের পরিমাণও কম থাকে। প্রচলিত উচ্চফলনশীল জাতগুলোতে জিঙ্কের গড়পড়তা পরিমাণ ১৫-১৬ মিলিগ্রাম। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভাতে জিঙ্কের পরিমাণ যদি এর গড় মাত্রা থেকে মাত্র ৮ মিলিগ্রাম বাড়িয়ে ২৪ মিলিগ্রাম করা যায়, তবে আমাদের মতো দেশগুলোর দরিদ্র মানুষের দৈনিক জিঙ্ক চাহিদার কমপক্ষে শতকরা ৪০ ভাগ পূরণ করা সম্ভব।
এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ২০০২ সন থেকে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। এ ক্ষেত্রে ব্রি ধান৬২ আমাদের প্রথম সাফল্য। এতে প্রতি কেজি চালে জিঙ্ক রয়েছে ১৯ মিলিগ্রাম। এটি আমন মৌসুমের উপযোগী আগাম জাত। সঠিক পরিচর্যায় এ জাতটি মাত্র ১০০ দিনে হেক্টরপ্রতি ৪.৫ টনের অধিক ফলন দিতে পারে। যেসব এলাকায় কৃষক আমন ধান কেটে একই জমিতে আগাম আলু বা শীতকালীন সবজি আবাদ করে অধিক লাভবান হতে চান সেসব এলাকার জন্য এ জাতটি বিশেষ উপযোগী। উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম দেশ হিসেবে এ ধরনের ধান অবমুক্ত করেছে।
আমাদের দেশের স্থানীয় জাত জিরাকাটারী ধানের সাথে ব্রি ধান৩৯ এর সঙ্করায়ন করে চিরায়ত প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি ইনব্রিড বা স্বপরাগী জাত বিধায় ফসল উৎপাদনে কৃষক নিজেদের সংরক্ষিত বীজ নিজেরা ব্যবহার করতে পারবেন, অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না।
২. শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য
পূর্ণবয়স্ক গাছের উচ্চতা ৯৮ সেমি.।
গড় জীবনকাল ১০০ দিন।
ডিগ পাতা খাড়া ও গাঢ় সবুজ রঙের।
১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৪ গ্রাম।
চালের আকার আকৃতি লম্বা, সরু এবং রঙ সাদা।
এ জাতের প্রতি কেজি চালে ১৯.৬ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে শতকরা ৯ ভাগ প্রোটিন।
হেক্টরপ্রতি ফলন ৪.৫ টন
৩. প্রচলিত জাতের তুলনায় এর উৎকর্ষতা
এ যাবতকালে অবমুক্ত আমন ধানের সর্বনিম্ন জীবন কালীন জাত।
ব্রি ধান৫৭ এর চেয়ে ব্রি ধান৬২ সাত দিন এবং ব্রি ধান৩৩ ও বিনা ধান৭ এর চেয়ে ১০-১৫ দিন আগে পাকে বিধায় আমন ধান কেটে একই জমিতে অনায়াসে আগাম গোল আলু বা রবিশস্য লাগানো সম্ভব।
এ ছাড়াও স্বল্প জীবনকাল হওয়ার এ জাতটি সহজেই খরা এড়িয়ে যেতে পারে।
প্রচলিত জাতের চেয়ে উচ্চমাত্রায় জিঙ্ক ও প্রোটিন থাকায় এ ধানের ভাত নিয়মিত গ্রহণে অসচ্ছল ও গরিব জনগোষ্ঠীর জিঙ্কজনিত অপুষ্টি দূরীকরণে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
৪. চাষাবাদ পদ্ধতি
এ ধানের চাষাবাদ অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতোই। মাঝারি উঁচু থেকে উঁচু জমি এ ধান চাষের জন্য উপযুক্ত। বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ৫ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই অর্থাৎ ২১ আষাঢ় থেকে ৩০ আষাঢ়।
বীজ বাছাই ও জাগ দেয়া এবং বীজ হার
রোগ, পোকা ও দাগ মুক্ত এবং পরিপুষ্ট বীজ হাত দিয়ে বেছে নিলে ভালো হয়। বীজ বাছাইয়ের কাজটি পরিবারের সবাই মিলে অবসর সময়ে করা যেতে পারে। বাছাইকৃত সুস্থ-সবল বীজ থেকে উৎপাদিত চারা গুণগত মানসম্পন্ন হবে এবং ফলনও বৃদ্ধি পাবে।
বাছাইকৃত বীজ ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে নিয়ে চটের ব্যাগ কিংবা ছালায় জড়িয়ে জাগ দিয়ে গজিয়ে নিতে হবে। ব্যাগ বা চট শুকিয়ে গেলে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে।
শতকরা ৮০ ভাগ গজানোর ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ পাতলা করে প্রতি বর্গমিটারে ৫০ গ্রাম বা শতকে ২ কেজি হারে বীজতলায় ফেলতে হবে। এতে সবল, সতেজ ও মোটাতাজা চারা উৎপন্ন হবে ।
বীজতলা তৈরি, সার প্রয়োগ ও চারা উৎপাদন
ভালো মানের চারা পেতে আদর্শ বীজতলা তৈরি করা প্রয়োজন। আদর্শ বীজতলা তৈরি করার জন্য নিম্নের পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
সেচ সুবিধাযুক্ত এবং প্রচুর আলো-বাতাস পায় এমন স্থান বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে।
বীজতলার জমিতে এক সপ্তাহ আগে পানি ঢুকিয়ে চাষ ও মই দিয়ে ঘাস ও খড়-কুটা পচিয়ে নিতে হবে। অতঃপর ভালোভাবে জমি চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাদাময় করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। সুস্থ-সবল ও মোটা তাজা চারার জন্য শেষ চাষের সময় নিম্নোক্তহারে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে-
সারের নাম প্রতি শতাংশে প্রতি বর্গমিটারে
গোবর ৪০ কেজি ১ কেজি
ইউরিয়া ৫২৮ গ্রাম ১৩ গ্রাম
টিএসপি ২৫৩ গ্রাম ৬ গ্রাম
দস্তা ৮০ গ্রাম ২ গ্রাম
ফুরাডান ৪০ গ্রাম ১ গ্রাম
জমির একপাশ থেকে ১ মিটার (৩৯.৩৭ ইঞ্চি) চওড়া করে লম্বালম্বিভাবে বীজতলা তৈরি করতে হবে।
দুই বীজতলার মাঝে ৫০ সেন্টিমিটার (১৯.৬৯ ইঞ্চি) জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে এবং এ ফাঁকা জায়গা থেকে মাটি তুলে নিয়ে দুই পাশের বীজতলাকে একটু উঁচু করতে হবে। এতে ফাঁকা জায়গায় নালার সৃষ্টি হবে। এ নালা দিয়ে প্রয়োজনে পানি সেচ দেয়া যাবে বা অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়া যাবে এবং নালায় প্রয়োজনীয় পানি ধরে রাখা যাবে।
বীজ বপনের আগে বাঁশ বা কাঠের চ্যাপ্টা লাঠি দিয়ে বীজতলাকে ভালোভাবে সমান করে নিতে হবে।
গজানো বীজ পাতলা করে সমহারে বীজতলায় ফেলতে হবে।
জমি তৈরি ও প্রাথমিক সার প্রয়োগ
চারা রোপণের দুই সপ্তাহ আগে জমিতে পানি ঢুকিয়ে চাষ ও মই দিয়ে আগাছা ও খড়-কুটা পচিয়ে নিতে হবে।
ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হবে এবং শেষ চাষের আগে প্রাথমিক সার ছকে উল্লিখিত হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সারের নাম কেজি-হেক্টর কেজি-বিঘা গ্রাম-শতাংশ
টিএসপি ৫২.৫ ৭ ২১২
এমপি ৮২.৫ ১১ ৩৩৪
জিপসাম ৬০ ৮ ২৪৩
দস্তা ১০ ১.৩ ৪০
সর্বশেষ জমি প্রস্তুতের সময় সবটুকু টিএসপি, এমপি সার, অর্ধেক জিপসাম এবং অর্ধেক জিঙ্ক সালফেট সার একসাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক এমপি সার ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক জিংক সালফেট ১ম কিস্তি ইউরিয়ার সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সালফারের অভাব পরিলক্ষিত হলে জিপসাম ইউরিয়ার মতো উপরিপ্রয়োগ করা যেতে পারে।
রোপণ দূরত্ব ও চারার বয়স
প্রতি গোছায় ২ থেকে ৩টি ২০ থেকে ২৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. এবং গোছা থেকে গোছার দূরত ১৫ সেমি. রাখতে হবে। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করলে প্রত্যেক গাছ সমানভাবে আলো, বাতাস ও সার গ্রহণের সুবিধা পাবে, এর ফলে ফলনও বেশি হবে। জমির উর্বরতাভেদে রোপণ দূরত্ব কম বেশি করা যেতে পারে
সার উপরিপ্রয়োগ
ধান লাগানোর ১০ দিন পর জমি আগাছামুক্ত করে প্রথম কিস্তি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রতি হেক্টরে ৮৫ কেজি (শতকে ৩৪০ গ্রাম) ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার গোছায় ৪-৫টি কুশি দেখা দিলে (প্রথম কিস্তির ১৫-২০ দিন পর) প্রতি হেক্টরে আরও ৮৫ কেজি (শতকে ৩৪০ গ্রাম) ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
ভালো ফলন পেতে ইউরিয়া সারের পরিবর্তে প্রতি চার গোছার মাঝে ২টি করে গুটি ইউরিয়া (১.৮ গ্রাম) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
সাধারণত ধানগাছ যত দিন মাঠে থাকে তার তিন ভাগের প্রথম এক ভাগ সময় আগাছামুক্ত রাখলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। সাধারণত প্রতি কিস্তি ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগের পর পরই আগাছা পরিষ্কার করে মাটির ভেতর পুঁতে দিলে জমির আগাছাও যেমন নির্মূল হবে তেমনি তা পচে গিয়ে জৈবসারের কাজ করে। জমিতে ১০-১৫ সেমি. পানি রাখতে পারলে আগাছার উপদ্রব কম দেখা দিবে। প্রয়োজনে আগাছানাশক কমিট ৪০০ মিলি ১০ কেজি ইউরিয়ার সাথে মিশিয়ে প্রতি একর জমিতে ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে।
পানি সেচ
রোপণের পর থেকে কাঁইচ থোড়-ফুল আসা এবং দুধ আসা পর্যন্ত জমিতে পানি থাকা জরুরি। এ সময় খরা হলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। তবে ভালো ফলনের জন্য ধানের দানা বাঁধা অবস্থা পর্যন্ত সেচ দেয়া প্রয়োজন।
ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালই দমন
অন্যান্য আমন ধানের মতোই এ জাতের ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। পোকা বা রোগাক্রান্ত হলে তা দমনে সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রধান ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করে এ ধানের ফলন শতকরা ২৫ ভাগ বাড়ানো যায়।
জমিতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা করে মাজরা পোকা সহজেই দমন করা যায়। এ ছাড়াও ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউজি হেক্টর ৭৫ গ্রাম বা প্রতি বিঘা জমির জন্য ১০ গ্রামের ১ প্যাকেট ভিরতাকো ব্যবহার করা যেতে পারে ।
প্রয়োজনে অন্য কীটনাশক যেমন কুরাটার-ভিটাফুরান ৫জি, মার্শাল ২০ ইসি, সানটাপ ৫০ এসপি, ডায়াজিনন ৬০ ইসি ইত্যাদি পোকাভেদে অনুমোদিত হারে স্প্রে করে দমন করা যেতে হবে।
জমিতে পাতাপোড়া রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ করে দিতে হবে। জমি থেকে পানি সরিয়ে শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিয়ে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি এমপি সার গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করলে পাতাপোড়া রোগের প্রকোপ কিছুটা কম হবে।
জমিতে খোলপচা রোগের প্রকোপ হলে ছত্রাকনাশক ফলিকুর (টেবুকোনাজল) ১০ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করা যেতে পারে। এ ছাড়াও কনটাফ (হেক্সাকোনাজল) বা টিল্ট (প্রপিকোনাজল) স্প্রে করা যেতে পারে। প্রথম স্প্রে করার ৭ দিন পর আর একবার স্প্রে করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
শিষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ দানা সোনালি রঙ ধারণ করলেই ফসল কেটে মাড়াই করতে হবে এবং অন্তত ৪-৫ বার রোদ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। ধানের বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শীষের শতকরা ৯০-১০০ ভাগ পাকার পর জমি থেকে আগাছা এবং অন্য ধানের জাত সরিয়ে ফেলে ফসল কাটতে হবে এবং আলাদাভাবে মাড়াই, ঝাড়াই ও ভালোভাবে রৌদ্রে শুকাতে হবে যাতে আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে।
ড. পার্থ সারথী বিশ্বাস*
* প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১